টাইফয়েড জ্বর এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ রোগ যা দূষিত পানি এবং খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এই টাইফয়েড জ্বর হলে পেট ব্যাথা, দুর্বলতা, মাথাব্যথা ইত্যাদি বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। অনেকেই জানতে চেয়ে থাকেন টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায় এবং টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায় আছে ? এই সকল প্রশ্নের উত্তর জানতে পারবেন এই আর্টিকেলে।
শরীরে জীবাণু প্রবেশ করার ৬ থেকে ৩০ দিন পর টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ দেখা যায় এবং কয়েক দিনের মধ্যে দ্রুত জ্বরের তীব্রতা বাড়তে থাকে তাই দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ না করলে হতে পারি মারাত্মক ঝুঁকি তাই টাইফয়েড জ্বর সম্পর্কে সবার সতেচন থাকা উচিত তাই এই আর্টিকেলে টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায় এবং টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায় গুলো কি কি সে বিষয়ে আলোচনা করব।
টাইফয়েড জ্বর কি ছোঁয়াচে
টাইফয়েড ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ একটি রোগ যা দূষিত পানি এবং খাবারের মাধ্যমে শরীরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করে। টাইফয়েড জ্বর ছোঁয়াচে রোগ। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এবং পানির মাধ্যমে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এই টাইফয়েড জ্বর একটি মারাত্মক রোগ। এই রোগে যদি কেউ আক্রান্ত হয় আর যদি সঠিক সময় চিকিৎসা না গ্রহণ করে
তাহলে মেরুদন্ড সংক্রমণ, রক্তক্ষরণ এছাড়াও কিডনিতে বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে তাই পরিবারের কেউ যদি এই রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তাকে আলাদা ঘর, খাবার, কাপড় সমস্ত কিছু আলাদা করে দিতে হবে কেননা একজনের কাছ থেকে পরিবারের সকলে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন কারণ এটি একটি ছোঁয়াচে রোগ।
টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ
টাইফয়েড জ্বর এক ধরনের পানি বাহিত বা খাদ্য বাহিত রোগ এটি আমাদের দেহে বিভিন্ন দূষিত খাবার এবং পানির মাধ্যমে প্রবেশ করে। অনেকে আছেন যারা একটু জ্বর হলেই কোভিড ১৯ মনে করেন এটি ভুল ধারণা এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে তাহলে কিভাবে বুঝবো টাইফয়েড জ্বর হয়েছে কিনা।
আরো পড়ুনঃ মুখে এলার্জি দূর করার ক্রিম ও সাবান
টাইফয়েড জ্বরের কিছু লক্ষণ রয়েছে যেগুলি আপনার মধ্যে দেখা দিলে বুঝবেন আপনার টাইফয়েড জ্বর হয়েছে। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ৬- ৩০ পর লক্ষণ দেখা যায়। চলুন তাহলে টাইফয়েড জ্বরের লক্ষণ গুলো কি কি সে সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।
- শরীরে প্রচন্ড ব্যথা হওয়া
- মাথাব্যথা বা মাথা ভারী ভারী ভাব
- প্রচন্ড কাশি হওয়া
- পেট ব্যথা
- খাবারের প্রতি অরুচি
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া
- কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া হওয়া
- শরীর ম্যাজ ম্যাজ বা ঝিমঝিম করা
- হার্টবিট কমে যাওয়া
- পিঠে অথবা পেটের উপরে দিকে লালচে দাগ হতে পারে।
- ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার থেকে বেশি হতে পারে প্রচন্ড জ্বর হওয়া।
- জ্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের দিকে বুকে অথবা পেটে লাল দানা ওঠা।
- ওষুধ খাওয়া অবস্থায় শরীরের জ্বর থাকা।
টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায়
আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা ধারণা করে টাইফয়েড জ্বর হলে গোসল করা যাবে না, গোসল করলে ঠান্ডা লেগে যাবে এবং গোসল করলে জ্বরের তীব্রতা বেড়ে যাবে ইত্যাদি। আমাদের বাংলাদেশে জ্বর হলে মাথায় পানি ঢালা, মাথায় পানিপটি দেওয়া বেশি জনপ্রিয় যা আমরা অনেকেই করে থাকি কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে টাইফয়েড জ্বর হলে গোসল করা একেবারেই নিষিদ্ধ নয়।
টাইফয়েড জ্বর জ্বর হলে আপনি গোসল করতে পারবেন তবে চেষ্টা করবেন গরম পানি দিয়ে গোসল করা এবং মাথায় বেশি পানি ঢালবেন না শরীরে বেশি পানি ঢালা এতে আপনার শরীরের তাপমাত্রাও কমে যাবে এবং কিছুটা স্বস্তি পাবেন এছাড়াও আপনি জ্বর কমানোর জন্য কপালে অথবা ঘাড়ে পানি পটি দিতে পারেন অথবা অল্প গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছ করতে পারেন।
টাইফয়েড জ্বর কত দিন থাকে
যদি কোন ব্যক্তি টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয় এবং দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ না করে তাহলে এই জ্বর সপ্তাহ অথবা মাশব্যাপী থাকতে পারে এবং রোগীর বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। ডাক্তারগন ইফয়েড জ্বরের চিকিৎসা সাধারণত এন্টিবায়োটিক দিয়ে করে থাকেন। এন্টিবায়োটিক সেবন করার পরও জ্বর কমতে ৫-৬ দিন লেগে যেতে পারে।
রোগীকে চিকিৎসার পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে তরল খাবার গ্রহণ করা উচিত কারণ এই টাইফয়েড জ্বরে দীর্ঘস্থায়ী জ্বর এবং ডায়রিয়া হয়ে থাকে যার কারণে শরীরে পানির ঘাটতি দেখা দেয় আর এই পানির ঘাটতি পূরণের জন্য রোগীকে তরল খাবার খাওয়ানো উচিত। টাইফয়েড জ্বর হলে রোগীকে বিশ্রামে রাখতে হবে।
আরো পড়ুনঃ গ্যাসটোনা ট্যাবলেট কি কাজ করে, কিসের ঔষধ
এবং জ্বরের তীব্রতা বেশি হলে শরীর গা মুছ করিয়ে দিতে হবে এতে শরীরের তাপমাত্রা কিছুটা কমে যাবে এবং রোগী স্বস্তি পাবে। অসুস্থ কালীন রোগীকে প্রচুর পরিমাণে পুষ্টি এবং উচ্চ গ্যালারি সমৃদ্ধ খাবার খাওয়াতে হবে এবং রোগী বাথরুমে যাওয়ার পর ভালোভাবে পানি দিয়ে হাত ধুতো করতে হবে এবং যতদিন ডাক্তার এন্টিবায়োটিক খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ততদিন পর্যন্ত খেয়ে যেতে হবে।
টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায়
টাইফয়েড জ্বর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হচ্ছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থাকা। তাছাড়া ডাক্তারগণ টাইফয়েড চিকিৎসার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে থাকেন এই অ্যান্টিবায়োটিক দুই ধরনের হয়ে থাকে একটি মুখে খাওয়া আর আরেকটি ইনজেকশন।
এই এন্টিবায়োটিক টাইফয়েড জ্বরের মূল চিকিৎসা। তাছাড়া চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু ঘরো উপায় রয়েছে যেগুলি অনুসরণ করলে আপনি খুব দ্রুত সুস্থ হতে পারবেন চলুন তাহলে টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায় গুলো কি কি সেগুলি জেনে নেওয়া যাক।
- ফুটানো পানি অথবা পরিষ্কার পানি বেশি পরিমাণে পানি পান করুন।
- পানি যাতে দূষিত না হয় সেক্ষেত্রে সংরক্ষণ করা পানি ২৪ ঘন্টার মধ্যে পান করুন।
- টয়লেট ব্যবহার করার পর হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিন।
- রাস্তার পাশে ফুটপাতে কোন খাবার অথবা পানি খাওয়া যাবে না।
- খাবার রান্না করার সময় ভালোভাবে সিদ্ধ করে খাওয়া উচিত।
- ফলমূল, শাকসবজি রান্না করার আগে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে।
- জ্বর বেশি হলে ঠান্ডা পানিতে কাপড় ভিজিয়ে কপালে পটি দিতে হবে।
- ঠান্ডা পানি দিয়ে কখনোই গোসল করা যাবে না তবে আপনি চাইলে হালকা গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে গা মুছ করতে পারেন এতে শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়।
- অ্যাপেল সিডার ভিনেগার সেবন করতে পারেন এতে প্রচুর এসিডিক উপাদান থাকে যা জ্বর কমাতে সাহায্য করে।
- রান্নায় আদা ব্যবহার করা কেননা আদাতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে যা রক্তকে বিশুদ্ধ করতে সহায়তা করে।
টাইফয়েড হলে কি খাওয়া উচিত
টাইফয়েডের সমস্যায় কি ধরনের খাদ্য তালিকা বা কি ধরনের খাদ্যাভ্যাস রাখবেন কিভাবে সেই সমস্যা থেকে মোকাবেলা করে সুস্থ হয়ে উঠবেন সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। “সালমোনেলা টাইফি” নামক এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার কারণে টাইফয়েড জ্বর হয়ে থাকে।
টাইফয়েড জ্বর হলে আমাদের শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা যায় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তাই টাইফয়েড হলে আমাদের খাদ্য অভ্যাস পরিবর্তন করা উচিত সেজন্য টাইফয়েড হলে কি ধরনের খাবার খাওয়া উচিত সেগুলি নিচে উল্লেখ করা হলো।
১. ডাবের পানি
টাইফয়েড জ্বর হলে শরীরে পানির অভাব দেখা যায় কারন এই সময় অনেক রোগীর ডায়রিয়া সমস্যা হয়ে থাকে যার ফলে শরীর থেকে তরল বা পানি বের হয়ে যায়। অনেক চিকিৎসকরা এই সময়ে রোগীদেরকে ডাবের পানি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে। এই সময় ডাবের পানি রোগীর জন্য খুবই উপকারী। এছাড়াও আপনি চাইলে ফলের রস, সুপ এবং শরবত খেতে পারেন।
২. কার্বনহাইড্রেট জাতীয় খাবার
টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে দ্রুত সুস্থ করতে কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার প্রয়োজন। বেশি পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট খাবার খেলে রোগীর হজম করতে সুবিধা হয় এবং শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টি পায় তাই টাইফয়েড আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতিদিন খাবার তালিকায় কার্বোহাইডেট জাতীয় খাবার রাখুন যেমন ভাত, সিদ্ধ আলো ইত্যাদি।
আরো পড়ুনঃ জিহ্বার গোড়ায় গোটা কেন হয় এবং করণীয় কি
৩. আঙ্গুর
টাইফয়েড হওয়ার পর শরীর দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে শুকনো আঙ্গুর খুবই কার্যকারী। এই শুকনো আঙ্গুর ইউনানী ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। টাইফয়েডের সময় প্রচন্ড জ্বরে ৪-৫টা আঙ্গুর ভিজিয়ে খেতে পারেন এতে অনেক উপকারী পাবেন এছাড়াও আপনি চাইলে শুকনো আঙ্গুর লবণ মিশিয়েও খেতে পারেন।
৪. দুগ্ধজাত খাবার
টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীদের শরীর প্রচন্ড ব্যথা করে এবং দুর্বলতা অনুভূতি হয় এই শারীরিক দুর্বলতা দূর করতে দুগ্ধজাত খাবার খুবই কার্যকারী ভূমিকা পালন করে। তাই টাইফয়েডে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে শক্তি বাড়াতে দুগ্ধজাত খাবার খাওয়া উচিত যেমন দই, পনির, ছানা ইত্যাদি।
৫. উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাবার
টাইফয়েডে জ্বরে আক্রান্ত হলে রোগীদের শরীর প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শরীরের ওজন কমতে থাকে তাই এই সমস্যা দূর করতে উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাবার খাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ উচ্চ ক্যালরি যুক্ত খাবার শরীরে শক্তি এবং ওজন বাড়াতে সহায়তা করে যেমন মিষ্টি আলু, কলা ইত্যাদি।
টাইফয়েড হলে কি চুল পড়ে যায়
টাইফয়েড হলে মাথার চুল পড়ে যায় এছাড়া যক্ষা, কোভিড-১৯, চিকেন পক্স বিভিন্ন সংক্রমণের কারণে চুল পড়ে যায়। তবে অন্য কোনো রোগ বলাই অথবা অপুষ্টির কারণে হঠাৎ মাথার চুল পড়ে যেতে পারে যেমন ভিটামিন ডি, আমিষ ও আয়রন এর অভাব। যাদের ক্যান্সারের রয়েছে তাদের রেডিও থেরাপি বা কেমোথেরাপি দেয়া হয় এই কারণেও প্রচুর পরিমাণে মাথার চুল পড়তে পারে।
শেষ কথা
টাইফয়েড জ্বর হলে আপনি গোসল করতে পারেন তাতে কোন মানা নেই তবে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে গোসল করার সময় কখনোই ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করা যাবে না এবং মাথায় বেশি পানি ঢালা যাবে না দরকার পড়লে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করবেন অথবা একটি গামছা ভিজিয়ে গা মোছ করতে পারেন।
আজকের এই আর্টিকেলে আপনাদের সাথে টাইফয়েড জ্বর হলে কি গোসল করা যায় এবং টাইফয়েড জ্বর ভালো করার উপায় কি কি সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি আশা করি আপনি সম্পূর্ণ পোস্টটি পড়েছেন এই পোস্টটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে অন্যদের সাথে শেয়ার করে দেবেন আর আপনার যদি কোন প্রশ্ন থেকে থাকে তবে নিচে কমেন্ট করতে পারেন ধন্যবাদ।